দ্য গ্রীন ক্যাপিটাল!
আগেই ঠিক করা ছিল যে এবার একটা লম্বা ট্রেন জার্নি করব। সেই মত বাঙ্গালোর থেকে গৌহাটির ট্রেন গৌহাটি এক্সপ্রেস এর টিকিট কাটলাম। ৫৪ ঘণ্টা শিডিউল টাইম! রাত সাড়ে এগারোটায় বাঙ্গালোর থেকে উঠলাম (যদিও ছাড়তে বেশ দেরী করেছিল), তিন রাত ট্রেনে কাটানোর পর সকাল সাড়ে পাঁচটায় গৌহাটি নামলাম। ৫১ ঘণ্টায়ই পৌঁছে যাই গৌহাটি। হলফ করে বলতে পারি, এই ট্রেন রাজধানি-দুরন্ত এর চেয়েও জোড়ে চলে। সমস্যা হয়েছিল একটু খাওয়া দাওয়া নিয়ে। যদিও অনেক ঘুরি বলে খাওয়া দাওয়া নিয়ে আমার তেমন সমস্যা হয় না, কিন্তু এবার একটু হয়েছিল। পরে স্টেশনে নেমে নেমে খাবার কিনে খেয়েছিলাম।
গৌহাটি নেমেই গাড়ীর খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম, গন্তব্য শিলং। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে বিধায় সবাই ৩ হাজার করে চাচ্ছিল। অনেক খোঁজার পর একজন ২২০০/- এ রাজি হল। গাড়ী নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম শিলঙের উদ্দেশ্যে। গৌহাটি থেকে শিলং হাইওয়ে এক অনিন্দ্য সুন্দর হাইওয়ে। অনেকটা পথই চার লেনের আঁকাবাঁকা রাস্তা পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। আর কিছুক্ষণ পর পর মেঘ এসে ভিজিয়ে দিয়ে যায়। ঠাণ্ডার সমস্যা না থাকলে অবশ্যই গাড়ীর জানালা খোলা রাখা উচিৎ। আমি একটু পর পর জানালা থেকে মাথা বের করে মেঘ খাচ্ছিলাম! মেঘে তো আর পেট ভরে না, তাই ঘন্টাখানেক পর গাড়ী থামিয়ে নাস্তা করে নিলাম।
ড্রাইভার টা বেশ ভাল ছিল। যাবার পথেই কামাখ্যা মন্দির, ব্রহ্মপুত্র নদী আর উমিয়াম লেক দেখিয়ে ১১ টার দিকে শিলং হোটেলের সামনে ছেড়ে দিয়ে আসে। ওনার ব্যবহারে খুশি হয়ে আমি ২৫০০/- এ দিয়ে দেই।
শিলং নেমে ঐ দিন আর কোন প্লান ছিল না। সোজা রুমে গিয়েই একটা ঘুম। বিকেলে বের হয়ে লাঞ্চ করলাম। এর পরে পুলিশ বাজারে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম। অনেক জমজমাট একটা এলাকা। হাজারো রকমের স্ট্রীট ফুড – সব যে সুস্বাদু তা বলব না। তবে আমি একটু চেষ্টা করি চেখে দেখার। রাতের খাবারের সময় খুঁজে বের করলাম একটা বাঙ্গালী হোটেল – অনেক দিন পর ভর্তা ভাত, মাছ, ডাল খেলাম! খেয়ে বের হয়ে পরদিন ঘোরার জন্য গাড়ী ঠিক করে রুমে ফিরলাম।
পরদিন নাস্তা করেই বের হয়ে গেলাম। শিলং পিক তখন বাংলাদেশের জন্য বন্ধ, তাই যেতে পারলাম না। এদিন সারা দিন আমরা ঘুরলাম ডন বস্কো মিউজিয়াম, মেঘালয় স্টেট মিউজিয়াম, শিলং ক্যাথেড্রাল চার্চ, ওয়ার্ডস লেক, লেডি হায়দারী পার্ক, ঈগল ফলস, এলিফ্যান্ট ফলস, গলফ কোর্স ইত্যাদি। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। তখন শুরু করলাম শিলং এর মধ্যে হাঁটা। এখানে হাঁটা একটু কষ্টকর, হঠাত হঠাত অনেক খাঁড়া রাস্তা। নামা যতটাই সহজ, ওঠা ততটাই কঠিন। প্রায় দু-তিন ঘণ্টা বিভিন্ন অলিগলি ঘুরে ফিরে এলাম তখন দোকান অনেক বন্ধ পুলিশ বাজারে। রাত ৯টার দিকেই কেমন যেন খালি হয়ে যায়।
পরদিন সকালে নাস্তা করেই রুম ছেড়ে দিয়ে চলে গেলাম সেরা আকর্ষন – লাইটলুম। জায়গাটা আমাদের কাছে বেশ অপরিচিতই। আমি প্রতি ট্যুরের আগেই একটু আনকমন জায়গা নিয়ে ঘাটাঘাটা করি। এবং এমন অন্তত একটা হলেও রাখি। শুধুমাত্র লাইটলুম যাবার কারণে গাড়িভাড়া ১০০০/- বেশি পড়ল। আমাদের গন্তব্য হল চেরাপুঞ্জী, কিন্তু লাইটলুম একটু অন্য দিকে – সেজন্য। কিন্তু যাবার পর মনে হল, ১০০০/- কেন ৪-৫০০০/- দিয়ে আসলেও পয়সা উসুল। ভয়ঙ্কর একটা সুন্দর জায়গা। এক পাশে মাইলের পর মাইল শুধু সবুজ উপত্যকা, আর এক পাশে গহীন গিরিখাদ! সবুজের মধ্যে আমরা প্রায় ২ ঘণ্টা হেঁটেছি, কোন কূল কিনারা পাইনি! আর তখন এত মেঘ ছিল মাঝে মাঝে এমনিতেও ১০ ফুট সামনের কিছু দেখা যাচ্ছিল না। একটা গা ছমছমে অনুভূতি। গিরিখাদ যে পাশে, ঐ পাশ টা বেশ বিপদজনক। একদম কিনারায় দাঁড়ালে পায়ের তালুতে একটা সুড়সুড় অনুভব করবেন!
লাইটলুম থেকে আমরা চেরাপুঞ্জির দিকে রওয়ানা দিলাম। সারাদিন আরো কয়েকটা স্পট দেখে সন্ধ্যায় পৌছালাম চেরাপুঞ্জী হলিডে রিসোর্টে। এটি একটু দামি রিসোর্ট হলেও এদের আতিথেয়তায় আপনি মুগ্ধ হতে বাধ্য। ডবল রুম ৪২০০/- আর সিঙ্গেল রুম ৩৪০০/- সাথে বুফে ব্রেকফাস্ট এবং ডিনার। খাবার পুরোই ভেজ। আপনি নন-ভেজ চাইলে বাড়তি পে করলে রেডি করে দিবে। খাবারের মান অসাধারণ, ডিনারে স্টার্টার এবং ডিজার্ট ও থাকে। এক এক দিন এক এক রকম আইটেম। নাস্তা এবং ডিনারের মেইন কোর্সে ৫-৬ রকম আইটেম থাকে। প্রতিদিন দু কাপ চা ফ্রি। আপনি যখন বাইরে থেকে হোটেলে আসবেন, ঢোকার সাথে সাথে আপনার ব্যাগ টা নিবে, এক গ্লাস পানি হাতে নিয়ে দাঁড়াবে। মনে হবে আপনি খুব পরিচিত কোন বাসায় এসেছেন। এখান থেকে আকাশ পরিষ্কার থাকলে বাংলাদেশ দেখা যায়। গ্রামীণের নেটওয়ার্ক পাবেন, বাড়িতে কথাও বলতে পারবেন। সমস্যা একটাই, রিসোর্টটা চেরাপুঞ্জী থেকে প্রায় ১৫ কিমি দূরে। যারা নিরিবিলি পছন্দ করেন না, তাদের অত ভাল নাও লাগতে পারে। এখান কার যাবার রাস্তাটা অনেক সুন্দর। আপনার মনে হবে কোন এডভেঞ্চারে যাচ্ছেন, সব সময় একটা গা ছমছমে ভাব রাস্তায়।
এখানে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৮.৩০টা পর্যন্ত ওদের কিছু শিল্পী গান গায়। ভিতরের ডাইনিং প্লেসে কফি হাতে নিয়ে বসে বসে লাইভ ওদের প্রোগ্রাম দেখতে পারেন।
পরদিন সকালে হোটেল থেকেই গাড়ী ঠিক করে দিল। আমরা বেরিয়ে পড়লাম। সারাদিন কত কত যে ঝর্না যে দেখলাম, সব গুলোর নামও জানি না। যে কয়টা মনে আছে, নিচে লিস্ট করে এক সাথে দিয়ে দিলাম। এদিন সব চেয়ে বড় আকর্ষন ছিল আরওয়াহ কেইভ। মউসমাই কেইভের চেয়েও আরওয়াহ কেইভ আমার কাছে বেশি ভাল লেগেছে। গেট থেকে এখানে যাবার দুইটা রাস্তা। একটা বাধাই করা রাস্তা, আর একটা ট্রেকিং। বৃষ্টির কারণে ট্রেকিং টা বন্ধ। আমরা রাস্তা ধরে গিয়ে গুহা ঘুরে ফেরার সময় সিদ্ধান্ত নিলাম ট্রেকিং করে ফিরব। ট্রেকিং এর একটা ভিডিও আগেই একটা গ্রুপে শেয়ার করেছিলাম বিধায়, আর বিস্তারিত লিখলাম না। আপনারা দেখে নিতে পারেন এখানেঃ https://www.facebook.com/groups/mail.tob/permalink/10155577540256790/
আরও ভাল লেগেছে ডেইনথলেন ফলস। এটা অনেকটা নায়াগ্রার মত। যদিও উপড়ে তেমন পানি ছিল না কারণ বর্ষার শুরু ছিল তখন। ভরা বর্ষায় যদি যান, অবশ্যই এখানে যাবেন। ইকো পার্কের মধ্যে ঢুকলে একদম ভিতরের দিকে চলে যাবেন। শুরুর দিকে সব মানুষের বানানো। কিন্তু একদম শেষের দিকে পুরাটাই ন্যাচারাল। ওখান দিয়ে বেশ বড় একটা ঝর্না দেখতে পাবেন। আমরা নোয়াকালিকাই ফলস দেখতে পারলেও মেঘের কারণে সেভেন সিস্টার ফলস ঠিক মত দেখতে পারিনি।
এদিন এবং আগের দিন যা যা দেখেছিঃ লিভিং র্যুট ব্রিজ, নোয়াকালিকাই ফলস, সেভেন সিস্টার ফলস, রেইনবো ফলস, মউসমাই ফলস, মউসমাই কেইভ, আরওয়াহ কেইভ, ইকো পার্ক, থাংখারাং পার্ক, ওয়াহকাবা ফলস, ডেইনথলেন ফলস, কিনরেম ফলস, বড়হিলস ফলস আর নাম মনে নেই 🙁
প্রতি ট্যুরের মত এই ট্যুরেও বারবিকিউ ক্যাম্পফায়ার করেছিলাম ফেরার আগের রাতে। হোটেল থেকেই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। পাশাপাশি পরদিন ডাউকি পর্যন্ত ফেরার গাড়ীও ঠিক করে দিল।
পরদিন আমরা যেহেতু খুব ভোরে বের হব যখন হোটেলের বুফে নাস্তা রেডি হবে না, তাই ওরা শর্ট করে আমাদের জন্য স্যান্ডউইচ করে পার্সেল করে দিল। আমরা খুব সকালে বেরিয়ে পড়লাম। এই প্রথম একজন ইংরেজি জানা ড্রাইভার পেলাম। ওনার বাড়ি মিজোরাম, উনি ৫ টা ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে, বাংলা পারেনা! ইংরেজি, হিন্দি অসমিজ আর লোকাল দুইটা। অসমিজ পারে বিধায় বাংলা কিছুটা বুঝে। বেশ স্মার্ট, পরিষ্কার ইংরেজী বলে। ফেরার সময়ই আমাদের বলে রেখেছে উনি আমাদের একটা ঝর্না দেখাবে যেটা এখনো অনেকেই চিনে না। আমরা রাজি হয়ে গেলাম। সেদিন আমাদের আরো একটা লিভিং র্যুট ব্রিজ দেখাল উনি। দুটো আরো ঝর্না দেখে, সেই বড় ঝর্নার কাছে নিয়ে গেল। গাড়ী রেখে প্রায় ১০০০ সিঁড়ি উঠতে হবে! এই ফলসের নামে ক্রাং সুরী ফলস। গিয়ে দেখি শুধু আমরাই সেখানে। বিশাল একটা ঝর্না। ঝর্নার উপড়েও ওঠা যায় আবার নিচেও নাম যায়। নিচে একটা লেকের মত আছে। আগে জানলে গোসল করার প্লান করে আসতাম!
ফেরার পথে আর একটা বড় আকর্ষন ছিল মাওলিনং – সবচেয়ে পরিষ্কার গ্রাম। গেলে মনে হবে কোন সাজানো স্টুডিওতে ঢুকে পড়েছেন। সব কিছু বেশ পরিপাটি। সেখান থেকে বের হয়ে সোজা স্নোনেংপেডেং। ঝুলন্ত ব্রিজে কিছুক্ষণ দোল খেয়ে নিচে নামলাম। ঠাণ্ডা পরিষ্কার পানিতে মুখ ধুয়ে ৪টার দিকে ডাউকি এসে, লাঞ্চ করে ৫টার মধ্যে ইমিগ্রেশন পার হয়ে গেলাম। ৬টার একটু আগে আমার সোনার বাংলায় পা রাখলাম 🙂
স্নোনেংপেডেং এবং মাওলিনং নিয়ে অনেক লেখা আছে বিধায় আমি আর বিস্তারিত বর্ননাতে গেলাম না।
মনে রাখবেন প্রকৃতি আমাদের প্রাণ। প্রকৃতি বাঁচলে আমরা বাঁচব। প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের। আমরা দয়া করে এমন কিছু করব না যাতে প্রকৃতি বিপন্ন হয়ে যায়। নিজেরা পরিষ্কার থাকব, প্রকৃতি পরিষ্কার রাখব।
[FAG id=4421]